নির্মাতাঃ হযরত মুহম্মদ (সা)
নির্মাণ তারিখঃ ৬২২ খ্রি.
পটভূমিঃ ৬২২ খ্রিস্টাব্দে রসূলে করীম (সাঃ) স্বদেশভূমি মক্কা ত্যাগ করে মদীনায় হিজরতের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। সঙ্গে হযরত আবুবকর (রাঃ) ও অন্যান্য সাহাবীদের নিয়ে তিনি প্রথমে পথিমধ্যে কুবা নামক স্থানে একটি মুসাল্লা নির্মাণ করে তথায় নামায আদায় করেন। নামাযের পর তিনি মদীনার দিকে রওয়ানা হলেন। উল্লেখ্য যে, মদীনার পূর্বনাম ছিল য়াছবির । মদীনা নবীর নগরী, তাই এটি মদীনাতুন নবী বা মদীনা মুনাওয়ারা নামে অভিহিত হয়। নবীজীর উট শহরের কেন্দ্রস্থলে এসে বসে পড়ে। ঐ স্থানটি ছিল একখণ্ড পতিত জমি যা খেজুর শুকান ও উট বাঁধার জন্য ব্যবহৃত হত। তিনি স্থানটি পছন্দ করে সেখানে একটি মসজিদ নির্মাণের পরিকল্পনা করেন। পতিত জমিটির মালিক ছিল সাহল ও সুহায়েল নাম্ক দুই অনাথ বালক। হযরত আবুবকর (রাঃ) দশ মিশকাল স্বর্ণ দিয়ে উক্ত জমি ক্রয় করেন। এরপর রসূলে করীম (সাঃ) উক্ত স্থানে মসজিদের ভিত্তি স্থাপন করেন। উল্লেখ্য যে, কেবলমাত্র মসজিদই নয় তাঁর পরিবার পরিজন এবং সাহাবীদের বসবাসের জন্য মসজিদের অভ্যন্তরে কুটির স্থাপিত হয়।
গঠন ও বৈশিষ্ট্য
আয়তন : সাহল ও সুহায়েলের জমি ক্রয় এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে নবী করীম এর সীমানা নির্ধারণ করেন। গৃহাঙ্গন বা মসজিদের পরিমাপ ছিল চতুষ্কোণাকার। আয়তন মোটামুটি ১০০ বর্গহাত অর্থাৎ ৫৬ গজ প্রত্যেক দিকে। এ এলাকার সীমানা চারদিকে প্রাচীর দিয়ে ঘেরা ছিল। প্রাচীরটির উচ্চতা ৭ হাত অর্থাৎ ১০-১১ এবং রোদে পোড়া কাঁচা ইট দিয়ে তৈরি ছিল। প্রাথমিক অবস্থায় এলাকাটি ছিল সম্পূর্ণ উন্মুক্ত কিন্তু পরবর্তী পর্যায়ে প্রখর সূর্যের তাপে নামাযের সময় মুসল্লীদের অসুবিধার কথা ভেবে নবী করীম (সা) উত্তর দিকে একটি পোর্টিকো বা ছাদ বিশিষ্ট ছাউনী নির্মাণের অনুমতি দেন। উত্তর দিকে খেজুর গাছের কান্ড দিয়ে দুই সারি শুভ বসান হয় এবং এরপর খেজুর পাতা ও কাদামাটি দিয়ে শুভরাজির উপর ছাদ নির্মিত হয়। ছাদ বিশিষ্ট পোর্টিকোটি দিয়ে যে প্রার্থনাগার নির্মিত হয় পরবর্তীকালে মসজিদের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ লিওয়ান হিসেবে তা পরিচিত।
প্রবেশপথ : মদীনার মসজিদটিতে প্রবেশের জন্য তিনটি প্রবেশপথ ছিল। দক্ষিণ দিকের প্রধান ফটক দিয়ে বিশ্বাসীগণ চত্বরে প্রবেশ করতেন। পশ্চিম দিকের ফটকটির নাম ছিল বাবুল আতীক বা বাবুল রাহমাত এবং পূর্ব দিকের প্রবেশপথটি বাবুল উসমান বা বাবুল জিবরাইল নামে পরিচিত ছিল। হযরত মুহাম্মদ (সা) বাবুল উসমান দিয়ে প্রবেশ
করতেন।
হুজরা : রসূলে করীম মদীনায় বসবাসের জন্য প্রাচীর বেষ্টিত এলাকার পূর্ব দিকের দক্ষিণ কোণায় দু'টি কুঠরী নির্মাণ করেন। এ প্রকোষ্ঠ দু'টি মহানবীর দু'জন স্ত্রী বিবি আয়েশা এবং বিবি সাওদার জন্য নির্দিষ্ট করা হয়। প্রকোষ্ঠ দু'টির প্রবেশ পথ পশ্চিম রিওয়ানের দিকে ছিল, বাহির থেকে কোন প্রবেশ পথ ছিল না। কাঁচা ইট দিয়ে দেওয়াল নির্মিত হয়। চিরাচরিতভাবে খেজুর গাছের পাতা ও কাদামাটি দিয়ে ছাদ তৈরি ছিল এবং ঘরগুলোও ঐভাবে বিভক্ত করা হয়। পূর্ব দিকে দু'টি প্রকোষ্ঠের সংলগ্ন এবং পাশাপাশি আরও ৭টি কুঠুরী তৈরি করা হয়। রসূলে করীমের স্ত্রীদের বসবাসের জন্যই এ ব্যবস্থা করা হয়। উল্লেখ্য যে, পশ্চিম দিকের প্রাচীরে কোন প্রকোষ্ঠ ছিল না। প্রতিটি প্রকোষ্ঠ অভি সাধারণ উপাদান দিয়ে তৈরি এবং পর্দা, যার পরিমাপ ছিল ৩ বর্গহাত, দ্বারা ঢাকা থাকত। কুঠরীগুলোর ছাদ ছিল খুবই নিচু, এত নিচু যে হাত দিয়ে স্পর্শ করা যেত। নবী করীম (সা) খুবই অনাড়ম্বর জীবন যাপন করতেন, তাঁর কোনও আসবাবপত্র ছিল না। মাটিতে বিছানা করে পরিবার পরিজন নিয়ে রাত্রি যাপন করতেন।
আসহাব'স সুফফা : মসজিদের উত্তর প্রাচীর সংলগ্ন চালাযুক্ত ঘরটি (সুফফা) ছিল আশ্রয়হীন মুহাজির সাহাবীদের আবাসস্থল। তাঁরা এ একচালা ঘর অবস্থান করতেন বলে এটি 'আসহাবুস সুফফা নামে খ্যাত।
কিবলাঃ মসজিদ স্থাপত্যের প্রধান প্রধান ধর্মীয় উপাদানগুলো সর্ব প্রথম মদীনা মসজিদে আত্মপ্রকাশ করে, যেমন কিবলা, মিনবার, মা যিনা। রসূলুল্লাহ (সা) মদীনায় আগমন করে, নব প্রতিষ্ঠিত মসজিদে প্রথমে জেরুজালেমের আল মসজিদুল আক্সার অথবা বায়তুল মুকাদ্দাস এর দিকে মুখ ফিরে নামায পড়তেন। এজন্য জেরুজালেমের আল-মসজিদুল আক্সা ইসলামের প্রথম কিবলা নামে পরিচিত হয়। ৬২২ থেকে ৬২৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত (অর্থাৎ ১৬ অথবা ১৭ মাস) জেরুজালেম ইসলামের কিবলা ছিল কিন্তু ৬২৪ খ্রিস্টাব্দে রসূলে করীম মদীনার উপকণ্ঠে এক মসজিদে যখন নামাযরত ছিলেন তখন ওহীর মাধ্যমে কিবলা পরিবর্তনের নির্দেশ পান। ১৫ই সাবান ২য় হিজরী অর্থাৎ ৬২৪ খ্রিস্টাব্দের ১১ই জানুয়ারি তিনি যখন দ্বিতীয় বার সিজদায় গিয়েছিলেন ঠিক তখনই তাঁর উপর ওহী নাজেল হল এ মর্মে যে, বায়তুল মুকাদ্দিস থেকে আল মসজিদুল হারামের দিকে মুখ ফিরাও এবং নামায আদায় কর। আল্লাহর নির্দেশে তিনি সমগ্র মুসল্লীদের নিয়ে উত্তর দিক থেকে দক্ষিণ দিকে মুখ ফিরালেন। এ ঘটনার পর থেকেই এ মসজিদকে দুই কিবলা বিশিষ্ট মসজিদ বা মসজিদুল কিবলাতায়েন বলা হয় ।
তাৎপর্যঃ কিবলা পরিবর্তনের ফলে মদীনা মসজিদের অঙ্গ সৌষ্ঠব ও উপাদানের সামান্য রদবদল করার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। কা'বা শরীফ ইসলামের কিবলা হিসেবে নির্দিষ্ট হয় এবং বিশ্বের মসজিদের নির্মাণকালে কিবলা নির্ধারণ করা অত্যাবশ্যকীয় করণীয় হয়ে দাঁড়ায়। কিবলা পরিবর্তনের ফলে মদীনা মসজিদটির অভ্যন্তরীণ উপাদান ও ব্যবস্থাগুলো রদবদল করতে হয়। লিওয়ানটি উত্তর দিক থেকে দক্ষিণ দিকে স্থানান্তরিত করা হয় এবং উত্তরে প্রাচীরের মধ্যবর্তী স্থানে যেখানে মিহরাব থাকে সেখানে একটি প্রবেশ পথ তৈরি করা হয়। কাঠামো পরিবর্তন করে আসহাবুস সুফফার স্থান দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে উত্তর-পশ্চিম কোণে স্থানান্তরিত করা হয়।
কিবলা পরিবর্তনের রাজনৈতিক ও ধর্মীয় গুরুত্বের উল্লেখ করে ক্রেসওয়েল বলেন, "Change of direction of prayer meant a new political and moral orientation on the part of Muhammad, the affirmation that Makka, and noit Jerusalem was the centre of the world and the Muslims not the Jews were the Keepers of the Truth."
মিহরাব ও মিনবার : মসজিদের অন্যতম প্রধান অঙ্গ হচ্ছে মিহরাব। ৬২২ খ্রি. মদীনার মসজিদে মিহরাবের ব্যবহার হয়নি। মিহরাব স্থাপনের পূর্বে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) একটি খেজুর গাছের কাণ্ডে হেলান দিয়ে খুৎবা পাঠ করতেন। অতঃপর তাবারীর মতে, ৬২৯ সালে সর্ব প্রথম মিনবার ব্যবহৃত হয়। আল গাবা উপত্যকা থেকে গ্রীক ছুতার মিস্ত্রী দিয়ে এ মিনবার তৈরি করা হয়। তিন ধাপ বিশিষ্ট এ মিনবার সম্ভবত গ্রীক ছুতার মিস্ত্রী বাককুম তৈরি করেন। এ মিস্ত্রী ছিল কোন আনসার অথবা মুহাজিরের স্ত্রী ক্রীতদাস। মতান্তরে, মিস্ত্রীর নাম ছিল ইব্রাহীম (বুখারী)। রসূলে করীম সর্বোচ্চ তৃতীয় ধাপে বসে দ্বিতীয় ধাপে পা রাখতেন এবং পরবর্তীকালে দ্বিতীয় ধাপে হযরত আবু বকর (রাঃ) এবং প্রথম ধাপে হযরত ওমর (রাঃ) বসতেন। প্রথম দুই খলিফা হযরত মুহাম্মদ (সা) এর প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকায় তৃতীয় ধাপে বসতেন না। মিনবার ব্যবহারের উদ্দেশ্য ছিল সমবেত বিরাট জনতা যাতে মহানবীর (সা) খুৎবা ও বাণী স্পষ্টভাবে শুনতে সক্ষম হয়। ইবনুল আছীরের বর্ণনা মতে, সাহাবীদের অনুরোধক্রমে মসজিদে একটি মিনবার স্থাপন করা হয়।